Tuesday, March 15, 2011

মার্কিন খেলা ফাঁস দূতাবাসের বার্তায়, বেছে বেছে মার্কিনপন্থীদের মন্ত্রী করেছেন মনমোহন

ভারতের মন্ত্রিসভায় রদবদল হচ্ছে, খুশি হচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। কোন কোন মন্ত্রী ‘মার্কিনপন্থী’, কে কে মন্ত্রী হওয়ায় আমেরিকার লাভ হবে, স্পষ্ট জানানো হচ্ছে নয়াদিল্লির মার্কিন দূতাবাস থেকে।

এমন যে হচ্ছে, তার ইঙ্গিত ছিলোই। এখন ‘উইকিলিকস’ দিল্লির মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনকে পাঠানো বার্তা ফাঁস করে তার প্রমাণ দিনের আলোয় এনে দিয়েছে। এই বার্তা বা কেবলস এখন ভারতের সংবাদমাধ্যমের হাতে এসে পৌঁছেছে। মঙ্গলবার তার কিছু অংশ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেই দেখা যাচ্ছে, ২০০৬-র জানুয়ারি মাসে ইউ পি এ মন্ত্রিসভায় যে রদবদল হয়েছিল, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করেছে। পেট্রোলিয়াম দপ্তরের মন্ত্রী মণিশঙ্কর আয়ারকে সরিয়ে দেওয়া হয় ইরানের সঙ্গে পাইপলাইন চুক্তি নিয়ে এগোনোর ফলে। তার বদলে ওই দপ্তরে আনা হয় মুরলী দেওরাকে, যাঁকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলছেন ‘মার্কিনপন্থী’। ভারত-আমেরিকা সংসদীয় ফোরামের সাতজনকে মন্ত্রী করা হয়, এমন সাতজন যাঁরা ‘প্রকাশ্যেই মার্কিন রণনীতির পক্ষে সওয়াল করে থাকেন’। ওই রদবদল সম্পর্কে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড মালফোর্ড তাঁর ঊর্ধ্বতনদের জানাচ্ছেন, ‘ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করার প্রত্যয় নিয়েই’ এই পরিবর্তন করা হয়েছে।

ইউ পি এ সরকার তৈরি হয় ২০০৪-এ। বামপন্থীদের চাপের মুখে থাকা ওই সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় যা নয়া উদারনীতির রথকে শ্লথ করে দেয়। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক-সামরিক সম্পর্ক তৈরির যে প্রক্রিয়া এন ডি এ সরকার শুরু করেছিল, তা-ও শ্লথ হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। ২০০৬-র ২৮শে জানুয়ারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রদবদল বামপন্থীরা-সহ অনেকের মনেই প্রশ্ন তুলেছিল। সচেতনভাবেই মার্কিন-মুখী, তথাকথিত সংস্কারমুখী অভিমুখ জোরদার করার লক্ষ্য নিয়েই ওই রদবদল করা হয়েছে বলে অভিযোগও উঠেছিল। বিশেষ করে ইরানের বিরুদ্ধে ভারতকে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে, সেই কারণেই চাপের মুখে ইরানের সঙ্গে পাইপলাইনের কোনো চুক্তি যেন না হয় তার চেষ্টা চলছে এই অভিযোগও উঠেছিল। সেই পাইপলাইনের জোরালো সমর্থক মণিশঙ্কর আইয়ারকে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এখন দেখা যাচ্ছে, অভিযোগ সঠিক। মার্কিন প্রভাব কতটা ক্রিয়াশীল ছিলো, তার প্রমাণ দিল্লির রাষ্ট্রদূতের পাঠানো কেবলসের ছত্রে ছত্রে।

কী বার্তা পাঠিয়েছিলেন ডেভিড মালফোর্ড? ২০০৬-র ৩০শে জানুয়ারি পাঠানো কেবলসের (৫১০৮৮: গোপন) কিছু উদ্ধৃতি:

-ইউ পি এ’র ২৮শে জানুয়ারি মন্ত্রিসভার রদবদল ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করার প্রত্যয় নিয়েই।

-বিতর্কিত ও ইরানের পাইপলাইনের সওয়ালকারী মণিশঙ্কর আইয়ারের বদলে মার্কিনপন্থী মুরলী দেওরাকে নিয়ে আসা হয়েছে। আইয়ার মার্কিন-বিরোধিতা করতেন। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে দূতাবাসের সম্পর্ক আছে। দেওরা ভারত-মার্কিন সম্পর্ক জোরদার করার অগ্রণী সমর্থক। দেওরা গান্ধী পরিবারের অনুগামী, মুম্বাইয়ের ধনী শিল্পপতি এবং রিলায়েন্সের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। রিলায়েন্সের তেলের ব্যবসায় তাঁর উল্লেখযোগ্য শেয়ার আছে।

-গ্যাস অথরিটিতে আমাদের সূত্র জানাচ্ছে আইয়ার ইরান-পাকিস্তান-ভারত পাইপলাইনের হয়ে কথা বলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকেও বিপদে ফেলে দিয়েছিলেন।

-আমাদের স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কের হয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথা বলছেন এবং ভারত-আমেরিকা সংসদীয় ফোরামের সাত জনকে মন্ত্রী করা হয়েছে।

-আমাদের প্রাথমিক মূল্যায়ন হলো শক্তি সংক্রান্ত মন্ত্রকে নতুন তিন মন্ত্রী নিয়োগ মার্কিন সরকারের স্বার্থের পক্ষে ভালো। মার্কিন-মুখী পরিবর্তন হলো।

- এই রদবদল মার্কিন সরকারের পক্ষে অনেক সুসংবাদ বহন করে এনেছে। সাইফুদ্দিন সোজ, আনন্দ শর্মা, অশ্বিনী কুমার, কপিল সিবাল, মুরলী দেওরার জোরদার মার্কিনপন্থী রেকর্ড রয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতির ভারত সফরের আগে এই বার্তা দেওয়া হলো।

-মন্ত্রিসভার রদবদলের মার্কিনপন্থী ঝোঁক অস্বীকার করা যাবে না। বামপন্থীরা এতে ক্রুদ্ধ হয়েছেন। তাঁরা মনে করছেন এটি খোলাখুলি যুদ্ধের আমন্ত্রণ। বামপন্থীরা মনে করছেন কংগ্রেস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা নিচু করছেন। এর ফলে তাঁরা আরো ক্ষুব্ধ হয়ে আরো অসহযোগিতা করবে। বামপন্থীদের সঙ্গে কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব বাড়ছে এবং আরো সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়ছে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই ধারণাটি পরে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে বামপন্থীদের বিরোধিতা তুঙ্গে ওঠে। বামপন্থীরা বারংবার অভিযোগ করছিলেন, মার্কিন চাপে এমনকি দেশের বিদেশনীতি নির্ধারিত হচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে, মালফোর্ড ২০০৬-র শুরুতেই বার্তা পাঠাচ্ছেন মনমোহন সরকারের কাজে ‘আমাদের বিদেশ মন্ত্রক’ (মার্কিন বিদেশ মন্ত্রক) খুশি। বামপন্থীদের অভিযোগ এখন প্রমাণিত।

স্বাভাবিকভাবেই এই দলিল ফাঁস হওয়ায় অস্বস্তিতে মনমোহন সরকার। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এই সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না। যদিও বিশ্বজুড়েই উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য নিয়ে রাজনৈতিক শোরগোল চলছে।


মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড মালফোর্ডের পাঠানো কেবল।


Source: Ganashakti, 15th March 2011

No comments:

Post a Comment